কেনাকাটায় এফ-কমার্স
পণ্যসামগ্রী কেনাকাটায় বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া কমার্স বা এফ-কমার্স। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে একটা পেজ খুলে সেখানে নিজেদের পণ্যের ছবি বিস্তারিত দামসমেত আপলোড করা হয়। ছবি দেখে সেই পণ্য এবং দাম মনমতো হলে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তা ফোনে বা ই-মেইলে যোগাযোগ করে কিনতে পারেন।
পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সময় (ক্যাশ অন ডেলিভারি) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য নেওয়া হয়। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং পছন্দ করে কেনার পুরো বিষয়টিই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা ফেসবুকে।
বেশ কয়েক বছর ধরে এই এফ-কমার্স নিজের বাজার তৈরি করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে এফ-কমার্সের জনপ্রিয়তা। এফ-কমার্সের উদ্যোক্তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নারী। সংসারের কাজের পর নারীরা এই মাধ্যমে উপার্জনের একটা উপায় খুঁজে পাচ্ছেন। অনেকে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করছেন। অথবা পুরোপুরি উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহে এগিয়ে আসছেন অনেক নারী। নিজেদের মেধা ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে এফ-কমার্স।
এফ-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘শৈলী’র কর্ণধার তাহমিনা শৈলী জানান, ২০০৬ সালে ফেসবুকে আসেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গয়না ও হস্তশিল্পের ওপর আগ্রহ ছিল। এই আগ্রহে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন তিনি। তাঁর তৈরি গয়না, শাড়িসহ হাতের তৈরি বিভিন্ন পণ্য তুলে ধরেন সেখানে। প্রথমে শুধু বন্ধু ও আত্মীয়রা পণ্যটি কিনতে আগ্রহী হতো। কাজটা বড় পরিসরে করতে তারা উৎসাহ দিত।
শৈলী জানান, এই ব্যবসার পাশাপাশি তিনি চাকরি করতেন। কিন্তু একসময় সবার উৎসাহ ও প্রেরণায় ২০১৪ সাল থেকে পুরোপুরি উদ্যোক্তা হয়ে যান তিনি। দাঁড় করান প্রতিষ্ঠান ‘শৈলী’কে। প্রায় ১৮টি দেশের গ্রাহক আছে এখন শৈলীর। ব্যাপক সমাদর পাচ্ছেন নিজের পণ্যের।
শৈলী মনে করেন, এফ-কমার্সের মাধ্যমে নারীরা নিজেদের পছন্দের জায়গাটা তুলে ধরতে পারছেন। প্রকাশ করতে পারছেন তাঁদের মেধা। তবে এফ-কমার্সের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তা হতে হলে বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ক্রেতা একবার নিজেকে প্রতারিত মনে করলে তিনি কখনো আর অনলাইনে কিনতে আগ্রহী হবেন না। এ বিষয় মাথায় রাখতেই হয়।
সীমিত পণ্যের ওপর এখন আর এফ-কমার্স সীমাবদ্ধ নেই। প্রথম প্রথম দেখা যেত পোশাক, শাড়ি—এগুলো মানুষ অনলাইন থেকে বেশি কিনত। এখন নিত্যপণ্য চাল-ডাল থেকে শুরু করে গৃহস্থালি, ইলেকট্রনিক বিভিন্ন জিনিস, এমনকি পাহাড়ি খাবারও ফরমাশ করা যায় অনলাইনে।
কিছুদিন আগেও ‘কাস্টমাইজড কেক’ বা থিমভিত্তিক কেকের ধারণা খুব বেশি পরিচিত ছিল না। ‘পুনিজ কিচেন’ এই কাস্টমাইজড কেকের ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করে এফ-কমার্সে। এর অন্যতম কর্ণধার আনিকা আলম জানান, কেক তৈরির এই পরিকল্পনা নিয়ে তিনি যখন পেজ খুললেন, তখন খুব কম উদ্যোক্তাই ছিল। ধীরে ধীরে তিন বছর ধরে দাঁড় করিয়েছেন তাঁর এই ব্যবসা। তাঁর কেকের নকশায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতবিতান’ থেকে শুরু করে মেকআপ বক্সের অবিকল প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় একটি বেকারি প্রতিষ্ঠানের রূপে দাঁড় করাতে পেরেছেন ‘পুনিজ কিচেন’কে।
আনিকা আলম বলেন, অনেক নারীকে কেক তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। যেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারী নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন।
এ ধরনের উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ নিতে বেশ কিছু জিনিসের প্রয়োজন হয়। নিজের ব্যবসায় একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ থাকতে হয়। নিজস্ব পণ্যের ক্ষেত্রে কারখানা স্থাপনের বিষয় থাকে; এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হয়। তবে নিজ উদ্যোগ ও আগ্রহ থাকলে খুব সহজে প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যায় এফ-কমার্সে। এখানে মূল্য পরিশোধের বিষয়টি পুরোপুরি অনলাইনে হয় না, তাই এটা ই-কমার্স থেকে কিছুটা আলাদা।
ফেসবুক থেকে পণ্য কিনছেন—এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাস্তার জ্যাম ঠেলে শপিং মলে যাওয়ার চেয়ে অনলাইনে কেনাকাটা এখন স্বস্তিকর তাঁদের জন্য। তাঁরা জানান, অনলাইনে ছবি দেখে পণ্যটি কেনা হয় বলে অনেক সময় সামনাসামনি দেখে পছন্দ হয় না। এ ক্ষেত্রে পণ্যটি পাল্টে নেওয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া প্রিয়জনকে উপহার দিয়ে চমকে দিতে এই অনলাইন কেনাকাটার বিষয়টি বেশ উপকারী। অবশ্য সময়মতো পণ্য পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন।
এ বিষয়ে এফ-কমার্সের উদ্যোক্তারা জানান, পণ্য পরিবহনে কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে নিবন্ধন করা হয়। অনেক সময় কুরিয়ারগুলো সময়মতো পণ্য পৌঁছায় না। এসব ক্ষেত্রে তাই তাঁদের কিছু করার থাকে না।
পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতার অভাব দেখা যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশেষ করে অনেক নারী তাঁদের পণ্যের কী দাম নির্ধারণ করবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ে থাকেন। পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারিত হয় না। এসব ক্ষেত্রে কিছুটা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় প্রতারণার মতো ঘটনা ঘটে। তাই পরিচিতি একটা বড় বিষয় এ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে। দেখা যায়, একজনের কাছ থেকে প্রতারিত হলে অন্যজনের কাছ থেকেও পণ্য নেওয়া বা এই ব্যবসার জনপ্রিয়তা হারায়। তাই এফ-কমার্সের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের জায়গাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।